দেশের যে অঞ্চলে বজ্রপাত বেশি হচ্ছে

জুনের প্রথম সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা বেড়েছে। এর মধ্যে গত রবিবার (৬ জুন) একদিনেই দেশের চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, ফেনী, টাঙ্গাইল, রংপুর ও মুন্সীগঞ্জসহ আরো কয়েকটি জেলায় বজ্রপাতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। 

আবহাওয়া অফিস বলছে, দেশে মার্চ থেকে মে ও অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বজ্রঝড় হয়ে থাকে। মার্চ-এপ্রিল-মে মাস বজ্রপাতের জন্য অনকূল পরিবেশ বিরাজের প্রবণতা থাকলেও মৌসুমগত পরিবর্তনের কারণে মে-জুলাইয়েও তা বিস্তৃত হতে পারে।

এদিকে নেত্রকোনা, নরসিংদী, কুমিল্লা- মিলে দেশের মধ্যাঞ্চলকে বজ্রপাতের হটস্পট বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ আবহাওয়াবিদরা। 

সিনিয়র আবহাওয়াবিদ ড. আবদুল মান্নান বলেন, দেশে বজ্রপাতের হটস্পট হচ্ছে মধ্যাঞ্চল। আমরা তথ্য পর্যালোচনা করে পেয়েছি যে- দেশের নেত্রকোনা, নরসিংদী ও কুমিল্লা- এ মধ্যাঞ্চল বজ্রপাতের হটস্পট। বজ্রপাতের অনুকূল পরিবেশের মধ্যে এ অঞ্চলে সাম্প্রতি সময়ে বেশি হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে।

তিনি আরো বলেন, ঊর্ধ্বাকাশে এখন প্রচুর জলীয় বাষ্প রয়েছে। এ সময় উত্তর থেকে ঠাণ্ডা হাওয়াও ধাবমান। একদিক থেকে গরম ও আর্দ্র হাওয়া আর অন্য দিক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস- এমন পরিস্থিতে বজ্রপাতের ঘটনাই স্বাভাবিক, যা কয়েক ঘণ্টার স্বল্প সময়ের মধ্যে তীব্র রূপ নেয়।

আবহাওয়া অধিদফরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে দেড়শোর মতো মানুষ মারা যায়। আর মারা যাওয়াদের প্রায় ৭০ শতাংশ কৃষক। বেশিরভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে হাওর অঞ্চলে। মানুষ ছাড়াও বজ্রপাতে প্রচুর গবাদি পশুও মারা যায়। মৃত্যুর সংখ্যা বিচার করে সরকার বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে ভেনিজুয়েলা ও ব্রাজিলে। সেখানকার চেয়েও বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা বেশি। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা অসচেতনতাকেই বেশি দায়ী করছেন। তারা বলছেন, কোন পরিস্থিতিতে ঘরে থাকতে হবে, সেটা সাধারণ মানুষ জানে না। জানলেও অনেকে মেনে চলে না।

থাইল্যান্ডে তালগাছ লাগিয়ে ও ভিয়েতনামে উঁচু টাওয়ারের মাধ্যমে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা কমিয়েছে। এছাড়া অনেক দেশই বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড ব্যবহার করছে।

ফিনল্যান্ডের বজ্রপাতবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ভাইসালার হিসাবে, বাংলাদেশে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ৪০ লাখ বা তার বেশিসংখ্যক বজ্রপাত মেঘ থেকে ভূমিতে নেমে আসে। ২০১৯ সালে তা প্রায় ১০ লাখ কমে যায়। সর্বশেষ গত বছর সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখের কিছু কম। বজ্রপাতে গত বছর ১৪৪ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যা আগের দুই বছরের চেয়ে কিছুটা কম। বজ্রপাতের ক্ষেত্রে একটি অস্বাভাবিক বছর ছিল ২০১৬ সাল। ওই বছর প্রায় ৪৩ লাখ বজ্রপাত হয়। মারা যায় প্রায় ২৬৩ জন মানুষ।

আবহাওয়াবিদ মান্নান বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বজ্রপাতের তীব্রতা বেড়েছে। ‘ইভেন্টের পার্টিকুলার ডে বা শর্ট পিরিয়ডে’ বেশি বজ্রপাত বৈশিষ্ট বেড়ে গেছে। সাম্প্রতিককালে বজ্রপাতের এমন ঘটনাকে ‘শর্ট লিফট লাইটেনিং ফেনোমেনা’ বলা হয়- এর ঘনঘটা বাড়ছে। যেখানে বজ্রপাত ১২-১৫ দিন হওয়ার কথা, সেখানে হয়ত ৩১ দিনই বজ্রপাতের ঘটনা রয়েছে কোনো না কোনো জায়গায়। কোনোদিন কম, কোনো দিন বেশি তীব্রতা ছিল। তার মানে এ ফেনোমেনার ধারাবাহিক আচরনের মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক জানান, বজ্রপাত নিরোধক লাইটনিং অ্যারেস্টার  স্থাপনা করার পাশাপাশি আর্লিওয়ার্নিংয়ের সর্বশেষ প্রযুক্তি কাজে লাগাতে প্রচেষ্টা রয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের অধীনে ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, পঞ্চগড়, নওগাঁ, খুলনা, পটুয়াখালী ও চট্টগ্রামে বজ্রপাত ডিটেকটিভ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। তাতে বিভিন্ন সময়ে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত হচ্ছে। যেসব জায়গায় বেশি বজ্রপাত হচ্ছে সেসব এলাকায় বজ্রপাতনিরোধক প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য জোর দেয়া হবে। আগাম বার্তা দেয়ার বিষয়টি আমাদের প্রজেক্টেও যুক্ত রাখার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। হাওর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট নেয়া হয়েছে। চলনবিল ও বরেন্দ্র এলাকায় বজ্রপাত নিরোধক স্থাপনা করা হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ও বাতাসে সিসার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, বনভূমি বা গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছ কমে যাওয়া, জনজীবনে ধাতব পদার্থের ব্যবহার ও মোবাইল ফোনের টাওয়ারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, জলাভূমি ভরাট ও নদী শুকিয়ে যাওয়া বজ্রপাত বেড়েছে। এছাড়া সব ভবনে বজ্রপাত নিরোধক রড ব্যবহার করার বিধান থাকলেও রাজধানীতে মানা হলেও অন্য জায়গায় তা আমলেই নেয়া হয় না।

আগে সাধারণত প্রতি বাড়িতেই তালগাছ, নারিকেলগাছ, সুপারিগাছ থাকত। এছাড়া মাঠের মধ্যেও তালগাছ ও বটগাছ থাকত। আর বজ্রপাত যেহেতু ভূপৃষ্ঠের উঁচু জায়গায় পড়ে থাকে, তাই গাছ মানুষকে রক্ষা করত। কিন্তু এ ধরনের উঁচু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

খোলা জায়গায় উঁচু গাছ থাকলে তাতে বজ্রপাতবাহিত হয়ে তা ভূমি স্পর্শ করে। তালগাছ সাধারণ সবচেয়ে উঁচু হয়ে থাকে। বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রচুর পরিমাণে তালগাছ ও নারকেল গাছ রোপণ করার উদ্যোগ রয়েছে সরকারের।

বজ্রপাত থেকে বাঁচতে

বজ্রপাতে প্রাণহানি ও আহত হওয়া ঠেকাতে মানুষের সচেতনতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতর বজ্রপাতে মৃত্যু বা হতাহত হবার ঘটনা এড়াতে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। এগুলো হলো:

১. বজ্রঝড় সাধারণত ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট স্থায়ী হয়। এ সময়টুকু ঘরে অবস্থান করতে হবে। অতি জরুরি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে হলে রাবারের জুতা পরে বাইরে যাবেন, এটি বজ্রঝড় বা বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা দেবে।

২. বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা খোলামাঠে যদি থাকেন তাহলে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে ও কানে আঙুল দিয়ে নিচু হয়ে বসে পড়তে হবে।

৩. বজ্রপাতের আশংকা দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। ভবনের ছাদে বা উঁচু ভূমিতে যাওয়া উচিত হবে না।

৪. বজ্রপাতের সময় যেকোনো ধরণের খেলাধুলা থেকে শিশুকে বিরত রাখতে হবে, ঘরের ভেতরে অবস্থান করতে হবে।

৫. খালি জায়গায় যদি উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ধাতব পদার্থ বা মোবাইল টাওয়ার থাকে, তার কাছাকাছি থাকবেন না। বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে থাকা বিপজ্জনক।

৬. বজ্রপাতের সময় ছাউনিবিহীন নৌকায় মাছ ধরতে না যাওয়াই উচিৎ হবে। সমুদ্রে বা নদীতে থাকলে মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে।

৭. জানালা থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি ধাতব বস্তু এড়িয়ে চলা, টিভি-ফ্রিজ না ধরা, গাড়ির ভেতর অবস্থান না করা এবং খালি পায়ে না থাকারও পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। যদি কেউ গাড়ির ভেতর অবস্থান করেন, তাহলে গাড়ির ধাতব অংশের সংস্পর্ষে আসা যাবে না।

বিশেষজ্ঞরা আরো বলেছেন, আবহাওয়া সম্পর্কিত দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বজ্রপাত। জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। আবহাওয়া অধিদফতরের সাপ্তাহিক ও দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাস তালিকায় নতুন যুক্ত হয়েছে বজ্রঝড়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //